হিপনোটাইজ বিদ্যা কে (Hypnotism –হিপনোটিজম) এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিদ্যা বলা যেতে পারে। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার একটি দৃশ্যে আমরা দেখেতে পাই অন্ধকার ঘরে ছোট্ট মুকুলের চোখে টর্চের আলো ফেলে নকল ডাক্তার হাজরা তাকে হিপনোটাইজ করে সোনার কেল্লা কোথায় তার হদিস জেনে নিচ্ছে।
এই ভাবে সম্মোহন বিদ্যার সাহায্যে সম্মোহনকারী সম্মোহিত ব্যক্তির কাছ থেকে যে কোনও খবর জেনে নিতে পারে। এমনকী তাকে দিয়ে ইচ্ছা মত নানা কাজও করিয়ে নেওয়া যায়। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সম্মোহন থেকে ফেরার পর তার কিছুই মনে থাকবে না যে সে কি বলেছে বা করেছে।
তীব্র আবেগ ও কল্পনা শক্তি দ্বারা অন্যের মনকে প্রভাবিত করা এবং পরিচালনা করাকে বলা হয় হিপনোসিস। প্রাচীনকাল থেকেই সম্মোহন বিদ্যা প্রচলিত রয়েছে মানব সমাজে। সে কালে এই বিদ্যাকে যাদুবিদ্যা বা অলৌকিক ক্ষমতা বলে মানুষ বিশ্বাস করত। অষ্টাদশ শতকে সম্মোহন বিদ্যার নামকরণ হয় ‘মেজমেরিজম’ অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের ডাক্তার ফ্রাণ্ডস্ অ্যান্টন মেজমার সম্মোহন বিদ্যার চর্চা শুরু করেন। ফলে এর ব্যাপক প্রচার শুরু হয় এবং ডাক্তারের নামানুসারে সবাই একে ‘মেজমেরিজম’ বলতে থাকে।
১৮৪০ সালে স্কটল্যাণ্ডের এক ডাক্তার জেমস ব্রেড নতুন নামকরণ করেন। গ্রিক শব্দে ঘুমের দেবতার নাম ‘হুপ্নস’ এই শব্দের অর্থ হল ঘুম। সম্মোহিত ব্যক্তি যে হেতু এক প্রকার ঘুমের ঘোরে কাজ করে যায় তাই ডাক্তার ব্রেড এই বিদ্যার নাম দিলেন ‘হিপনোটিজম’ এ নামই বর্তমানে প্রচলিত।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই বিদ্যাকে প্রথম কাজে লাগান ইংল্যাণ্ডের ডাক্তার এস ডেল। তিনি সম্মোহনের সাহায্যে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে দাঁত তুলতেন, ছোটখাট অপারেশনও করতেন।
হিপনোটাইজড অবস্থায় মানুষের এমন অনেক ঘটনার কথা মনে পড়ে যার পুরোটাই তার ‘ফলস মেমারি’। যা তার অবচেতন মনে লুকায়িত ছিল। তা বলে ফেলার পর মন হালকা হয়ে যায় এবং সেই মানুষ মানসিক ভাবে সুস্থ হয়ে যায়।
হিপনোটিক থেরাপি চিকিৎসাক্ষেত্রে শরীর ও মনের রোগ সারানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। একে ‘অলটারনেটিভ সায়েন্স বা অলটারনেটিভ থেরাপি’ বলা হয়ে থাকে। সম্মোহনচর্চা জানলে তা প্রয়োগ করে আর্থ্রারাইটিস, হাইপারথাইরয়েডিজম থেকে শুরু করে অ্যাজমা, ক্রনিক হজমের সমস্যা, মদ বা ধূমপান অভ্যাস, বন্ধ্যাত্ব, স্ট্রোকের ফলে হওয়া পঙ্গুত্ব, অ্যাংজাইটি, মাইগ্রেন, বাত বা ক্যানসারের যন্ত্রণা, অনিদ্রা, ফোবিয়া, উচ্চরক্তচাপ, ওজন বৃদ্ধি এসব সমস্যার সমাধান করা যায়।
মানুষের মস্তিষ্কের থেকে শক্তিশালী কিছু নেই। সেক্ষেত্রে তার মানসিক ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে অনেক রোগই ভাল করা যায়। হিপনোসিসের মাধ্যমে সেটা বৈজ্ঞানিক ভাবে সম্ভব।
শুধুমাত্র কথা বলে লোককে হিপনোটাইজ করে শারীরিক স্থূলতার মতো সমস্যার সমাধান করতে পারেন একজন হিপনো বিশেষজ্ঞ। কথার মাধ্যমে হিপনোটাইজ করে তিনি রোগীর মাথায় এমন একটি ধারণা ঢুকিয়ে দেন যে, তার মনে হতে থাকে যে পাকস্থলীটা ছোট হয়ে গিয়েছে। যেমন অনেকটা বেরিয়াট্রিক সার্জারি করালে হয়। এর ফলে তার ওজন কমে।
কিভাবে করা হয় এই সম্মোহন-
এটি কোন ধরনের জাদু বিদ্যা না। সম্পূর্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করা হয়। হিপনোসিস চলাকালীন সময়ে মস্তিষ্কের সচেতন অংশকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে ঐ ব্যক্তির বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং তাকে শিথিল করার দিকে মনোনিবেশ করা হয়।
যখন আমাদের মন কোন একটি নির্দিষ্ট দিকে নিবিষ্ট হয়, কেন্দ্রীভূত হয় তখনই আমরা শক্তি অনুভব করি। যখন কোন ব্যক্তি সম্মোহিত হয় তখন তার মাঝে কিছু শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন তার নাড়ীর স্পন্দন কমে যায়, শ্বাস প্রশ্বাসও কমে যায়। সেই সাথে তার মস্তিষ্কের আলফা স্তরে ঢেউ খেলতে থাকে। এই সময়ে ঐ ব্যক্তিকে কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বা বিশেষ কোন নির্দেশনা প্রদান করা হয়। সম্মোহিত করার ধাপগুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়।
১। সম্মোহনের জন্য তৈরি করা-
এমন কাউকে বেছে নিতে হবে যে সম্মোহিত হতে চায়। এর অন্যথা হলে সম্মোহন করা বেশ কষ্টসাধ্য। এতে যে তার কোন ক্ষতি হবে না তাও নিশ্চিত করতে হবে। কেননা এই ব্যাপারটা সম্পূর্নভাবে মানসিক। সম্মতি না থাকলে সাব-কনসাস মাইন্ড তাকে সম্মোহিত হতে দিবে না। যার পূর্বে মানসিক ডিসঅর্ডার এর রেকর্ড আছে তাদের সম্মোহন না করাই ভাল। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
২। অধিষ্ঠায়ন
এটি এমন একটা প্রক্রিয়া, যে ব্যক্তিকে সম্মোহিত করা হবে তার স্নায়ুকে শিথিল করে দিতে হবে। এখানে সম্মোহনকারীকে থাকতে হবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অবিচল এবং কোমল। আর অবশ্যই তার সকল আদেশ নির্দেশ হতে হবে ইতিবাচক। আরাম চেয়ারে বসিয়ে বা শুইয়ে দিয়ে তাকে এমন কিছু নির্দেশ দিতে হবে। যেমনঃ হাত দুটো আরাম করে কোলের উপর রাখো……এখন তাকাও আমার হাতের দিকে। ছোট আঙ্গুলের/চেইনটির/মাঝের বিন্দুটির দিকে তাকাও… তাকিয়ে থাকো….. নিশ্বাস নাও ……. অনেক জোরে নিশ্বাস টেনে নাও বুক ভরে….. নিঃশ্বাস ধরে রাখো… এবার ছাড়ো।
৩। গভীরে নেয়া
দ্বিতীয় অংশটুকুর মাঝেই এই ধাপটি আসে। সম্মোহনকারী পারিপার্শ্বিক কিছু যুক্ত করে অন্য রকম একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন। সম্মোহিত ব্যক্তির খুব পছন্দের কোন গান চালিয়ে তাকে কাল্পনিক ভাবে তার প্রিয় কোন স্মৃতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। ক্রমেই তাকে ঐ মুহুর্তের গভীরে নিয়ে যেতে হবে। যেন তার কাছে মুহুর্তটি বাস্তব বলে মনে হয়। সন্মোহনকারীর প্রতিটা কথায় বাক্যে বা নির্দেশে সন্মোহিত ব্যাক্তি চলে যাবে আরও শিথিলতায়। প্রতিটি নিঃশ্বাস তাকে নিয়ে যাবে আরও গভীরে। ব্যক্তি যত গভীরে প্রবেশ করবে তাকে সম্মোহন করার ক্ষমতা ততটাই সম্মোহনকারীর হাতে চলে আসবে।
৪। অভিভাবন
সম্মোহিত ব্যাক্তির হাতের দুটি আঙ্গুল এক এক করে ধরে হালকা চাপ দিয়ে যদি তাকে বলা হয় তোমার দু’আঙ্গুল জুড়ে দেয়া হয়েছে যাদু দিয়ে এখন দু আঙ্গুল একসাথেই লেগে থাকবে। বলা যাবে না তুমি আর আঙ্গুল দুটো খুলতে পারবে না। অর্থাৎ কখনো নেতিবাচক বা না শব্দটি উচ্চারণ করা যাবে না। তাহলে অবচেতন মন সচেতন হয়ে যাবে আর না শব্দটি গ্রহণ করবে না। ফলে সম্মোহন কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। ধীরে ধীরে বলতে হবে যাদুর আঠায় তোমার আঙ্গুল আরো বেশী জোড়া লেগে যাচ্ছে। যখন সে আর খুলতে পারবে না তখন বলতে হবে আমি এক, দুই, তিন (অপেক্ষাকৃত জোরে) বলার সাথে সাথে তোমার আঙ্গুলের জোড়া খুলে যাবে। গভীরতা বাড়ানোর জন্য বলা যেতে পারে ১০ থেকে ০ পর্যন্ত গুণব।
প্রতিটি সংখ্যার সাথে সাথে তুমি আরো ২ গুন গভীরে চলে যাবে। ১০, ৯, ৮, ৭ এভাবে ধীরে ধীরে গুনতে হবে। সন্মোহিত ব্যাক্তির হাতে কল্পনায় গ্যাস বেলুন বেধে দিয়ে বলা যায় যে হাত হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। বেলুন উপরে উঠে হাত উপরে উঠিয়ে নেবে আরও ৫০/৬০টা বেলুন বেধে দিয়ে আরও হাল্কা করে দেয়া যায় হাত যত উপরে উঠবে বলতে হবে তোমার হাত হালকা হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে আর তুমি ভালো ফিল করছো।
যত চাচ্ছো তত উপরে উঠছে হাতটা। ঠিক যেন আকাশে উড়ছো তুমি। এ সময়ে ব্যক্তির মন অত্যন্ত হালকা অবস্থায় থাকবে। তাকে এ অবস্থায় যে কোন কিছু বিশ্বাস করানো যায়। তাকে যদি বলা হয় তুমি একেবারে সুস্থ, তোমার কোন রোগ নেই কিংবা তার জীবনের কোন দুঃখজনক ঘটনা তার জীবনে ঘটেনি বলে বিশ্বাস করালে সে এই ধারনা নিয়েই সম্মোহন থেকে জেগে উঠবে।
৫। জাগিয়ে তোলা
সম্মোহন থেকে বাস্তব জগতে নিয়ে আসার জন্য বলতে হবে, আমি ১ থেকে ৫ পর্যন্ত গুনব আর ৫ বলার সাথে সাথে তুমি জেগে উঠবে। তখন তোমার অনেক ভালো লাগবে এবং তুমি অনেক হালকা বোধ করবে।
খুব ভালো একটা ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর তোমার যেমন চনমনে লাগে ঠিক তেমনি। তুমি হবে একজন সুখী মানুষ, ঠিক যেমনটা তুমি হতে চেয়েছিলে। এবার ১ থেকে ৫ পর্যন্ত গোনা শেষ হলেই সম্মোহিত ব্যাক্তি সন্মোহন কেটে জেগে উঠবে।
হিপনোথেরাপির উদ্দেশ্য কাউকে হিপনোটাইজ করা নয় বরং রোগীকে তাঁর সমস্যা থেকে উদ্ধার করা। হিপনোথেরাপি হল প্রোগ্রামিং অফ সাবকনসাস মাইন্ড। এটা অনেক দ্রুত কাজ করে, যা কিনা সমস্যার মূলে সরাসরি আঘাত করতে পারে। তবে অভিভাবন ঠিকঠাক না হলে মনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
কারো কারো ক্ষেত্রে একটি-দুটি অতিরিক্ত শব্দ গ্রহণ বা বর্জন সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। অতএব যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত হিপনোথেরাপিস্ট ছাড়া অন্য কারও কাছে থেরাপি নেওয়া উচিত নয়। বহু রকমের অসুখ-বিসুখ সারানো সম্ভব হিপনোথেরাপির মাধ্যমে।
সারানো যায় বললে কম বলা হয়, বলা যায় একেবারে নির্মূল করা যায়, তাও বিনা ঔষধে। ব্যক্তিত্ব ও ক্যারিয়ার গঠনেও হিপনোথেরাপি ভালো কাজ করে। এছাড়াও পড়াশোনায় অমনোযোগ, অনিদ্রা, স্থূলতা, ডিপ্রেশন, রাগ কমানো, ক্ষুধামন্দা এসবের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা পদ্ধতির হিপনোটাইজ থিওরি।
আশা করছি বিস্তারিত বুঝতে পারছেন। এবং এই উওরটি আপনাকে কিছু হলেও সাহায্য করবে।